ক্রেডিট কার্ড কী ?ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা

 


বর্তমান আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় “ক্রেডিট কার্ড” একটি বহুল পরিচিত শব্দ। অনেকেই এটিকে শুধুমাত্র একটি লেনদেনের মাধ্যম মনে করলেও, এর পেছনে রয়েছে একটি জটিল আর্থিক কাঠামো এবং দায়িত্বশীল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব ক্রেডিট কার্ড কী, এটি কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা ও অসুবিধা, এবং সচেতন ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত।

ক্রেডিট কার্ড কী?

ক্রেডিট কার্ড হলো একটি প্লাস্টিক বা মেটাল কার্ড, যা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে প্রদান করে। এই কার্ডের মাধ্যমে আপনি এমনকি নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলেও পণ্য বা সেবা কিনতে পারেন – অর্থাৎ, ঋণ নিয়ে কেনাকাটা করার সুবিধা এটি দেয়।

ব্যাংক মূলত আপনাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ (যাকে বলে ক্রেডিট লিমিট) ধার দেয়। আপনি সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কেনাকাটা বা পেমেন্ট করতে পারেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই অর্থ পরিশোধ করতে হয়। সময়মতো পরিশোধ না করলে সুদ (interest) যোগ হয়।

ক্রেডিট কার্ড কিভাবে কাজ করে?

ক্রেডিট কার্ডের কাজ করার প্রক্রিয়াটি খুব সহজ:

  • ব্যাংক আপনাকে একটি নির্দিষ্ট লিমিট দেয় – যেমন ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
  • আপনি সেই পরিমাণ টাকার মধ্যে যেকোনো লেনদেন করতে পারবেন – যেমন অনলাইন কেনাকাটা, শপিং মল, হোটেল বুকিং, ফ্লাইট টিকিট, ইত্যাদি।
  • মাসের শেষে ব্যাংক আপনাকে একটি বিল/স্টেটমেন্ট পাঠায় যেখানে আপনি কত টাকা খরচ করেছেন তা দেখানো হয়।
  • আপনি চাইলে পুরো টাকাটাই একবারে পরিশোধ করতে পারেন, অথবা একটি ন্যূনতম পরিমাণ পরিশোধ করে বাকি টাকায় সুদ দিয়ে সময় নিয়ে পরিশোধ করতে পারেন।

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা

১. আর্থিক নমনীয়তা

আপনার কাছে নগদ টাকা না থাকলেও আপনি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য বা সেবা কিনতে পারেন। যেমন, জরুরি চিকিৎসা, জরুরি ভ্রমণ ইত্যাদি।

২. ইএমআই সুবিধা

বড় অঙ্কের কেনাকাটাকে আপনি কিস্তিতে ভাগ করে সহজে পরিশোধ করতে পারেন। যেমন, ল্যাপটপ, মোবাইল বা ঘরের আসবাব।

৩. ক্যাশব্যাক ও রিওয়ার্ড পয়েন্ট

অনেক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন অফার দেয় – যেমন: প্রতিবার লেনদেনের জন্য রিওয়ার্ড পয়েন্ট, ক্যাশব্যাক, ডিসকাউন্ট, ইত্যাদি।

৪. আন্তর্জাতিক লেনদেন

বিদেশে ভ্রমণ বা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে (যেমন Amazon, AliExpress) সহজে লেনদেন করা যায়।

৫. ক্রেডিট স্কোর বৃদ্ধি

সময়মতো ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করলে আপনার ক্রেডিট স্কোর উন্নত হয়, যা ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করে।

ক্রেডিট কার্ডের অসুবিধা

১. অতিরিক্ত খরচের ঝুঁকি

কার্ড হাতে থাকলে অনেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলেন, যা পরে ঋণের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

২. সুদের হার বেশি

আপনি যদি পুরো বিল পরিশোধ না করেন, তবে বাকি পরিমাণের ওপর উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়, যা অনেক সময় ৩০% বা তার বেশি হতে পারে।

৩. লুকানো ফি

অনেক সময় ব্যাংকগুলো বার্ষিক চার্জ, দেরিতে পেমেন্ট ফি, ক্যাশ উইথড্রয়াল চার্জ ইত্যাদি নেয়, যা গ্রাহকরা শুরুতে জানেন না।

৪. স্ক্যাম ও হ্যাকিং ঝুঁকি

অনলাইন ট্রানজ্যাকশনে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক না থাকে, তাহলে কার্ড ক্লোনিং বা ডেটা চুরি হতে পারে।

কোথায় ব্যবহার করা যাবে না

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অনলাইনে জুয়া খেলা, বৈদেশিক লেনদেন, ক্রিপ্টো কারেন্সি, লটারির টিকেট কেনা কিংবা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যাবে না।

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরেক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে উবারের বিল পরিশোধের সুযোগও বন্ধ করে দিয়েছে।

এর ফলে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে অর্থ পরিশোধে ঝামেলার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কী করা যাবে

সাধারণ অনলাইনে কেনাকাটা বা সরাসরি দোকানে গিয়ে ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায় ক্রেডিট কার্ড।

এনআরবি ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধান শফিকুল ইসলাম বলছেন ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা ঘরে বসেই ই-কমার্সের মাধ্যমে যে কোনো লাইফ স্টাইল পণ্য, সিনেমার টিকেট, খাবার, বাস রেলওয়ের টিকেট ক্রয়ের সুযোগ পান।

"বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা বিভিন্ন মার্চেন্ট আউটলেটে লাইফ স্টাইল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স কেনাকাটায় নানা ছাড় পেয়ে থাকেন।"

সাথে তিন থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে শূন্য শতাংশ সুদ কিস্তিতে মূল পরিশোধের সুযোগ থাকছে বলে জানান তিনি।

এক্ষেত্রে একজন গ্রাহক ১৫ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত কোনো সুদ ছাড়া অর্থ পরিশোধের সুযোগ পেয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক কার্ড চেকের মাধ্যমে দরকারি সময়ে নগদ অর্থ উঠাতে পারেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য বা সেবা ক্রয়, হোটেল বুকিং, বিদেশে শিক্ষা গ্রহণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ এবং বিদেশে প্রশিক্ষণ/সেমিনার/ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ ফি দেয়া যাবে।


ক্রেডিট কার্ডের সুবিধাগুলো:

  • দ্রুত লেনদেন (অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার না করে কার্ড ব্যবহার করে হাতে থাকা অর্থের চেয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের সুবিধা)
  • পুরস্কার পয়েন্ট (বিশেষ করে বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে এটি খুবই আকর্ষণীয়, যে সুবিধা ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন করলে পাওয়া যায়)
  • নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি থেকে মুক্তি
  • অধিকতর নিরাপদ (প্রচলিত ডেবিট কার্ডের চেয়ে ক্রেডিট কার্ডের সুরক্ষা অনেক বেশি)

সচেতনভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের টিপস

সবসময় সময়মতো বিল পরিশোধ করুন

এতে আপনি সুদের চাপ থেকে মুক্ত থাকবেন এবং ক্রেডিট স্কোরও ভালো থাকবে।

নিজের সাধ্যের বাইরে খরচ করবেন না

ক্রেডিট লিমিট থাকলেও, সেটা নিজের বাস্তব আয় অনুযায়ী ব্যবহার করুন।

অফার বা ডিসকাউন্ট দেখেই লেনদেন করবেন না

প্রতিটি অফার বা কিস্তির পেছনে শর্ত থাকে – আগে ভালোভাবে পড়ে নিন।

ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক থাকুন

বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোথাও কার্ডের তথ্য দেবেন না।

একাধিক কার্ড না রাখাই ভালো

একাধিক কার্ড থাকলে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয় এবং খরচ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অবস্থা

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ড সার্ভিস দেয়। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের শহরাঞ্চলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ব্যাপক। বিভিন্ন ব্যাংক যেমন:

  • ব্র্যাক ব্যাংক
  • ডাচ্-বাংলা ব্যাংক
  • ইস্টার্ন ব্যাংক
  • স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড
  • সিটি ব্যাংক (American Express)

এরা ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে থাকে।

উপসংহার

ক্রেডিট কার্ড আধুনিক জীবনের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি যেমন জরুরি মুহূর্তে সহায়তা করতে পারে, তেমনি অসতর্ক ব্যবহারে হতে পারে দায়বদ্ধতার বোঝা। সঠিক পরিকল্পনা, সময়মতো পরিশোধ এবং সচেতনতার মাধ্যমে আপনি এই কার্ডকে নিজের পক্ষে এক শক্তিশালী আর্থিক হাতিয়ার বানাতে পারেন।

অতএব, আপনি যদি এখনো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার শুরু না করে থাকেন, তবে আগে এর ব্যাপারে ভালোভাবে জেনে নিন এবং প্রয়োজনে আপনার আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি কার্ড গ্রহণ করুন।